গোলাম আজম খান: রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার করা মামলায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা গণহত্যাসহ চারটি নির্দেশনা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
এ আদেশ নিয়ে আশাবাদী, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আইসিজের রায় দেশে ফিরে যাওয়ার পথকে সুগম করবে বলে আশা তাদের। এ আদেশের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় বিশ্ব আদালত সোচ্চার হবে এমনটাই প্রত্যাশা আইন বিশেষজ্ঞদের।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালায় মিয়ানমার। দেশটির সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে নতুন করে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আইসিজেতে মামলা করে গাম্বিয়া। মামলায় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। এতে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম হতে পারে বলে মনে করে রোহিঙ্গারা।
আদেশের দ্রুত বাস্তবায়ন চান রোহিঙ্গা নেতারা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও জোড়ালোভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বলেছেন, মিয়ানমার সরকারের তদন্ত কমিটি প্রমাণ না পাওয়ার কথা বললেও ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের কাছে জোনোসাইডের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যা ইতিমধ্যে আদালতে উত্থাপন করা হয়েছে। এ আদেশের পাশাপাশি নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার আশা করছেন রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বলেন, আইসিজের আদেশে রোহিঙ্গাদের বিজয় হয়েছে। এরকম একটি বিজয়ের আশায় ছিল বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যার যথেষ্ট প্রমাণ আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করা হয়েছে। মিয়ানমারের সেনারা যুগ যুগ ধরে আমাদের ওপর জেনোসাইড চালিয়ে আসছিল। যা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে বড় আকারে জনসম্মুখে এসেছে। আদালতের আদেশের দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই। পাশাপাশি নিজ দেশে ফিরতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করছি।
আরও পড়ুন: আইসিজের রায় মিয়ানমারকে অবশ্যই মানতে হবে: তথ্যমন্ত্রী
রোহিঙ্গা নেতা আশহাব উল্লাহ বলেন, গণহত্যার কোন প্রমাণ মেলেনি বলে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে মিয়ানমারের একটি তদন্ত প্যানেল, তা সর্ম্পূণ মিথ্যা ও বানোয়াট। ১৪০ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে আমাদের মা-বোনদের ওপর পরিচালিত নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার কোন চিত্র উল্লেখ করা হয়নি। এ প্যানেল সরকারের কথামতো প্রতিবেদন দিয়েছিল।
আশহাব উল্লাহ আরও বলেন, মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য মিয়ানমার জেনোসাইডের ঘটনা অনেক আগে থেকে ঘটিয়ে আসছিল। মিয়ানমার সরকার জেনোসাইডের ঘটনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করছে। যাতে করে সেনাবাহিনীকে রক্ষা করা যায়। এমনকি সরকার সেদেশে শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা আইন তৈরি করেছে। আজকে আইসিজের দেওয়া আদেশ তাদের চক্রান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। যার জন্য খুশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত ও নানান নির্যাতন করার পরও থেমে নেই মিয়ানমারের অত্যাচার। মিয়ানমারে অবস্থানরত প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গার ওপর চলছে গণহত্যার উদ্দেশ্যে নির্যাতন। আইসিজের আদেশে রোহিঙ্গাদের বিজয় হয়েছে। আশা করছি সম্মান, নাগরিকত্ব ও মর্যাদা নিয়ে নিজ দেশে ফিরতে পারব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ রোহিঙ্গারা কৃতজ্ঞ আজ।
টেকনাফের লেদা শরণার্থী শিবির রোহিঙ্গা নেতা নুর বশর বলেন, গাম্বিয়া আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে রোহিঙ্গাদের যে উপকার করেছে, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার ফুফাতো ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছে; তার আপন দুই ভাই এখনও রাখাইনে বন্দি। মিয়ানমারে আমরা যে অত্যাচারের শিকার হয়েছি, আশা করছি এ রায়ে তার বিচার মিলবে।
ছৈয়দুল আমিন নামে আরেক এক রোহিঙ্গা বলেন, হেলিকপ্টার থেকে হামলা চালিয়ে তার এক ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। তার বাবা-মাকেও আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। সে জানে না তারা এখন বেঁচে আছে কিনা।
নুরুল হক নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে আমাদের জমি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এর পাশাপাশি রাখাইনে নাগরিকত্ব ও অধিকার নিয়ে ফিরতে পারব।
গত ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার যে ধর্ষণ, অত্যাচার-নিপীড়ন চালায় তার উদ্দেশ্য ছিল ‘গণহত্যা’ বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানির জন্য ১০ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারিখ নির্ধারণ করা হয়। প্রথম ধাপে ১০ ডিসেম্বর শুনানি করে গাম্বিয়া। আর ১১ ডিসেম্বর শুনানি করে মিয়ানমার।
ফেসবুকের মাধ্যমে মতামত জানানঃ