হিমেল তালুকদার, ঠাকুরগাঁও : আধুনিকতার উৎকর্ষতায় আর কালের আবর্তে বাংলার ঐতিহ্যবাহি মাটির ঘর এখন বিলুপ্তির পথে। ইট, বালু আর সিমেন্টের আধিপত্যে হারিয়ে যেতে বসেছে “এসি খ্যাত” মাটির তৈরি বাড়ির আভিজাত্য।
তবে ঠাকুরগাঁওয়ের সদরে অবস্থিত আদিবাসী সাঁওতাল পাড়ায় গেলে চোখ জুড়িয়ে যায় সেই ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরগুলো দেখলেই। যেন মাটির ঘরের ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব শুধু তাদের ওপরেই দেওয়া হয়েছে।
এই আধুনিক সময়ের সাথে আর দশজনের মত পরিবর্তনের ছোঁয়া পড়েছে আদিবাসীদের গায়েও । তারাও সভ্যতার সকল সুবিধার সাথে পরিচিত । কিন্তু এখনও এই মাটির ঘর ব্যবহারের কারণ হিসেবে তাদের মায়া জড়ানো সদিচ্ছাকেই ধরা যেতে পারে।
আদিবাসী বিলিয়ম’র নিকট জানতে চাইলে তিনি সময় জার্নালকে জানান, বাপ দাদাদের মাটির ঘরেই থাকতে দেখেছেন তারা। তারাও অনেকটাই অভ্যস্ত। তাছাড়া এই মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি কোঠাঘরের বিশেষত্ব আছে। আর তা হল এসব ঘরে প্রচণ্ড গরমের সময় ঠান্ডা এবং শীতের সময় গরম অনুভূত হয়।
ঠাকুরগাঁও সদরের আদিবাসী পাড়ায় ঘুরলে এখনও এমনই কয়েক’শ মাটির তৈরি ঘর চোখে পড়বে। মনে হবে যেন অন্য কোনো জগতের অংশ।
জানা যায়, এক সময় আদিবাসী পাড়ার মত ঠাকুরগাঁও জেলার অন্য সব গ্রামগুলোতে অধিকাংশ মানুষ এটেল মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি ঘরেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। এলাকায় বসবাসের প্রথম দিকে অধিকাংশ ছন বা খর দিয়ে ঘরের ছাওনি দিতেন। পরে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা টিন দিয়ে ছাওনি দিতে শুরু করেন। এটেল মাটির সাথে পাটের টুকরো এবং তাতে তুষ মিশিয়ে মন্থন করে প্রায় দুই সপ্তাহ পর তা দিয়ে প্রায় দেড় ফুট পুরো দেয়াল তৈরি করে ঘর নির্মাণ করা হয়। এতে মুজুর বাবদ খরচ হয় প্রায় তিন হাজার টাকা। তাছাড়া পাট ও তুষ কিনতে আরও প্রায় ৩’শ থেকে ৪’শ টাকা খরচ হয়।
মাটির বাড়িতে বসবাসকারী বিধান দাস তার নিজের হাতে বাড়িটি তৈরির অভিজ্ঞতা নিয়ে খোলামেলা আলাপে জানান, বাড়ি তৈরিতে এঁটেল মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হয়। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালের উপর কাঠ বা বাঁশের চাল তৈরি করে খড়-কুটা, গোলপাতা, টালী অথবা ঢেউটিন দিয়ে ছাওয়া হয়। মাটি কুপিয়ে ও পানি দিয়ে কাঁদায় পরিণত করার পদ্ধতিকে জাব বলা হয়। জাব কেটে তা সুচারুভাবে গেঁথে ভাঁজে ভাঁজে তৈরি করতে হয় দেয়াল।
দেয়ালের একেকটি ভাঁজের পুরুত্ত্ব ৩ থেকে ৪ ফুট। এভাবে ৫ থেকে ৬টি ভাঁজ শেষ হবার পর দেয়ালের উচ্চতা দাঁড়ায় ১৫-১৮ ফুট। যিনি মাটির চাপ গেঁথে দেয়াল ও বাঁশ দিয়ে চাল তৈরি করেন তাকে ঘরামি বলা হয়। চারিপাশে বারান্দা বিশিষ্ট ঘরকে আটচালা এবং ৩ পাশে বারান্দা বিশিষ্ট ঘরকে ৭ চালা ঘর বলা হয়। গৃহিনীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আলপনা একে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে থাকেন। শৈল্পিক আলপনায় ফুটে উঠে নিপুন কারুকার্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে ইট-সিমেন্টের ঘর নির্মাণে এখন উৎসাহী হচ্ছে মানুষ। এক সময় ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন গ্রামে অনেক পরিবার মাটির ঘরে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও প্রবল বর্ষণে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে এখন কাচা ঘর ফেলে পাঁকাঘর নির্মাণে করছেন সকলে।
জেলার গড়েয়া ইউনিয়নের রামধ পাড়া গ্রামের আরজু শিকদার সময় জার্নালকে বলেন, তাদের বাড়িতে মাটির তৈরি কয়েকটি ঘর ছিল। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সেইসব ঘর ভেঙ্গে এখন টিনের ঘর তৈরি করতে হয়েছে ।
ঠাকুরগাঁও রায়পুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক, মো. জাকির হোসেন ও আচকা গ্রামের ফজলু মাস্টারসহ অনেকেই জানান, তাদের বাব-দাদারাও মাটির তৈরি কোঠাঘরে বসবাস করতেন। কিন্তু বর্তমানে মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চোর-ডাকাতের কারণে লোকজন কোঠা ঘরের পরিবর্তে টিনের বা কেউ কেউ দালান দিয়েও বসত বাড়ি তৈরি করছেন।
সময় জার্নাল/
ফেসবুকের মাধ্যমে মতামত জানানঃ