নিউজ ডেস্ক: সিন্ডিকেটের কারসাজিতে গত ২ মাস ধরে ‘আকাশচুম্বী’ পেঁয়াজের দাম। রাজধানীতে এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে ভোক্তাকে খরচ করতে হয়েছে সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা।
তবে বিভিন্ন স্তর থেকে প্রশাসনের বাজার তদারকিতে রোববার থেকে নিত্যপণ্য এ পেঁয়াজের ঝাঁজ কমতে শুরু করে। পাশাপাশি নতুন পেঁয়াজ (পাতাসহ ছোট পেঁয়াজ) বাজারে আসতে শুরু করায় সোমবার পণ্যটির দাম আরও কমেছে।
রাজধানীর পাইকারি পর্যায়ে পণ্যটির দাম কেজিতে আগের দিনের (রোববার) তুলনায় ৮০ টাকা কমলেও, খুচরা পর্যায়ে কমেছে ৩০ টাকা।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৮০-২৩০ টাকা এবং পাইকারি বাজারে ১০০-১৬০ টাকা।
এদিন পণ্যটির দাম বৃদ্ধির কারণ জানাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন সংবাদ সম্মেলন করে বাণিজ্য সচিব জাফর উদ্দিন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।
আর সংকটকালীন এ সময় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যটির দাম আরও এক ধাপ বাড়িয়েছে। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৫শ’ জনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সোমবার রাজধানীর পেঁয়াজের পাইকারি আড়ত শ্যামবাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদিন সেখানে প্রতি কেজি দেশি নতুন পেঁয়াজ পাইকারি দরে বিক্রি হয়েছে ৯০-১০০ টাকা।
দেশি পুরাতন পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা। কিন্তু একদিন আগেও এ পুরাতন দেশি পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রেতারা বিক্রি করেছেন ২৩০-২৪০ টাকা। বাজার দর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একদিনের ব্যবধানে কমেছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা।
মিয়ানমানের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা। যা একদিন আগে বিক্রি হয় ২শ’ টাকা দরে।
একই দিন রাজধানীর নয়াবাজার, রামপুরা বাজার, সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বিক্রেতারা দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ২২০-২৩০ টাকা দরে।
যা একদিন আগেও খুচরা বাজারগুলোতে পণ্যটি বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৫০ টাকা। তবে রাজধানীর নয়াবাজারে পুরনো দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২০০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
তাছাড়া এদিন আমদানি করা মিয়ানমার ও মিসরের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৮০-১৯০ টাকা। যা একদিন আগে বিক্রি হয় ২০০-২১০ টাকা। এছাড়া নতুন পাতাসহ দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকা।
এদিকে দাম কমতে থাকায় ভোক্তার মুখে হাসি ফিরতে শুরু করেছে। তবে তারা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে যে হারে দাম বাড়িয়েছে, সেভাবে কমছে না।
তাদের কারসাজি এখনও বিদ্যমান আছে। তাই সংশ্লিষ্ট তদারকি কর্মকর্তাকে সার্বিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পণ্যটির দাম ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতায় আনতে হবে।
তাছাড়া এ দিন পণ্যটির দাম ভোক্তার ক্রয় ক্ষতায় আনতে রাজধানীর পেঁয়াজের পাইকারি আড়ত শ্যাম বাজারে অভিযান পরিচালনা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের তদারকি টিম।
এ সময় বাড়তি দরে বিক্রি করায় চার প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। শ্যাম বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো. লিয়াকদ বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে।
যার কারণে দাম কমেছে। ২ দিনে পাইকারি পর্যায়ে কেজিতে কমেছে ৮০-৯০ টাকা। তিনি বলেন, দিন যত যাবে সরবরাহ বাড়বে। এতে দাম আরও কমতে থাকবে।
সেগুনবাগিচা বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. আলাউদ্দিন বলেন, পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেছে। যে কারণে কম দামে এনে একটু কম দামেই বক্রি করছি।
পাইকারির তুলনায় খুচরায় দাম বেশির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের কিছু পেঁয়াজ বিক্রি এখনও বাকি আছে। আর নতুনও এনেছি যার কারণে মিলিয়ে লাভ রেখে বিক্রি করতে হচ্ছে।
একই বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. কানন বলেন, বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম কমছে। যে কারণে একটু ভালো লেগেছে। কিন্তু এখনও ২শ’ টাকায় পণ্যটি কিনতে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসাতে বিক্রেতারা পুরাতন পেঁয়াজের দাম কমাতে শুরু করেছেন। সংশ্লিষ্ট তদারকি টিমের নজরদারি বাড়ানো গেলে দাম আরও কমে আসবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, পেঁয়াজের দাম ভোক্তার ক্রয় ক্ষতায় আনতে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক শ্যামবাজার পেঁয়াজের পাইকারি আড়তে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
এ সময় মূল্য তালিকা না টাঙানো ও মূল্য তালিকায় প্রদর্শিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করার অপরাধে মেসার্স সেতু বাণিজ্যালয়কে ১০ হাজার টাকা, মেসার্স নাইমা বাণিজ্যালয়কে ১৫ হাজার টাকা, মেসার্স আসিফ বাণিজ্যালয়কে ৪০ হাজার টাকা এবং মেসার্স আবদুল্লাহ বাণিজ্যালয়কে ৫০ হাজার টাকাসহ ৪ প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
সচিবের সংবাদ সম্মেলন : ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব জাফর উদ্দিন। তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজ কেলেঙ্কারির ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৫শ’ অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য সচিব এসব কথা জানান। তবে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে লিখিত বক্তব্য পড়েই তিনি চলে যান।
এ সময় বাণিজ্য সচিব বলেন, সর্বনিম্ন রফতানি মূল্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি তিনগুণ বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে চারগুণ বেড়েছে। তড়িৎ গতিতে কার্গো বিমানে মিসর, তুরস্ক, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে।
আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, এস আলম গ্রুপের কার্গো বিমানের প্রথম চালান মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ এসে পৌঁছাবে। এছাড়া বিভিন্ন জেলার পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে।
টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) কার্যক্রম ঢাকাসহ সারা দেশে জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন তাদের তদরকি অব্যাহত রেখেছে।
এ পর্যন্ত আড়াই হাজার অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
জাফর উদ্দিন আরও বলেন, বাংলাদেশের আমদানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগ আসে ভারত থেকে। এ বছর বন্যার কারণে ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এজন্য সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পেঁয়াজের মিনিমাম এক্সপোর্ট প্রাইস ভারত থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। এরপর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারত পেঁয়াজ রফতানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘোষণা করে।
এ প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- এলসি মারজিন ও সুদের হার কমানো। আমদানিকারকদের ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশ হতে পেঁয়াজ আমদানি করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।
আমদানি করা পণ্য নির্বিঘ্নে খালাসের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সবাইকে প্রস্তুত রাখা।
তিনি বলেন, এলসির মাধ্যমে সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেড় মাসের মতো সময় লেগে যাচ্ছে। বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পেঁয়াজের চালান বাংলাদেশের উদ্দেশে সমুদ্রপথে রয়েছে।
সম্প্রতি মিয়ানমার পেঁয়াজের রফতানি মূল্য চারগুণ বাড়িয়েছে এবং ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে দু-এক দিন ধরে বাজারে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বিমানে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ফেসবুকের মাধ্যমে মতামত জানানঃ